শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারি: কিছু কথা - মণীশ রায়চৌধুরী



সারাদেশব্যপী দীর্ঘ সাত দফার ভোট গ্রহণের পরে অবশেষে শেষ হল লোকসভা নির্বাচন। তৃতীয় বারের জন্য এনডিএ শরিকদের উপর নির্ভর করে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি ক্ষমতায় ফিরল ঠিকই, কিন্তু গণদেবতার নির্দেশে নিজেকে ঈশ্বর ভাবতে শুরু করা নরেন্দ্র মোদীর দর্পচূর্ণ হল। প্রায় নিশ্চিহ্ন হতে বসা বিরোধীরা শক্তিশালী হয়ে সংসদে ফিরে এল, রক্ষা পেল ভারতীয় গণতন্ত্র।

এবারের লোকসভা নির্বাচনে বিরোধীদের যেসকল প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়েছে তার অন্যতম হল কেন্দ্র সরকার এবং প্রধানমন্ত্রীর চাটুকারে পর্যবসিত হওয়া মিডিয়া। আজকের দিনে মিডিয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। মিডিয়াই জনতার চোখে কোন ব্যক্তি বা দলের ভাবমূর্তি তৈরি করে। লোভী, চাটুকার মিডিয়া নিরন্তর প্রচারের মাধ্যমে বিজেপি বা বলা ভালো প্রধানমন্ত্রীর যে ছবি দেশবাসীর সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে তাতে তিনি দিব্য পুরুষ ঐশ্বরিক ক্ষমতা সম্পন্ন (কিছু ক্ষেত্রে তো ঈশ্বরেরও উর্ধ্বে) একমাত্র দেশরক্ষকে পরিণত হয়েছেন। অপরপক্ষে বিরোধীদের জন্য ছিল স্রেফ অবজ্ঞা। মিডিয়ায় বিরোধীদের বক্তব্য, দাবিদাওয়া, আন্দোলন যতদূর সম্ভব ব্ল্যাক আউট করা হয়েছে। বহুক্ষেত্রে তো মিডিয়ার দালালি এমন স্তরেও পৌঁছেছিল যে বিরোধীদের বিরোধিতা করতে চ্যানেল অ্যাঙ্কর নিজেই মঞ্চে অবতীর্ণ হয়েছে। 

১ জুন,২০২৪ সপ্তম দফার ভোট শেষ হতেই সমস্ত চ্যানেলে বরাবরের মতো এক্সিট পোল দেখানো হল। মোদী সরকারের 'আবকি বার চারশো পার' স্লোগানের সাথে তাল মিলিয়ে সব চ্যানেল প্রেডিকশন করে দিল যে আরও একবার মোদী ঝড় আসন্ন এবং বিরোধীরা তাতে খড়কুটোর মতো উড়ে যাবে। 
নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহ দুজনেই বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে এবার তারা চারশো আসন জিতবেনই এবং ৩ জুন শেয়ারবাজার খুললেই সেনসেক্স রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছাবে। এক্সিট পোলের ভরসায় ৩ জুন সেনসেক্স ৭৩,৯৬১.৩১ থেকে বেড়ে ৭৬,৪৬৮.৭৮ পৌঁছে গেল। নিফটি ২২,৫৩০.৭০ থেকে বেড়ে এক ধাক্কায় হয়ে গেল ২৩,২৬৩.৯০। স্বাভাবিক ভাবেই একদিনেই সমস্ত শেয়ারের দাম বৃদ্ধি পেল। বিশেষত প্রধানমন্ত্রীর কৃপাধন্য আদানি এবং রিলায়েন্স গোষ্ঠীর শেয়ারে রকেটের গতি দেখা গেল। 
রাহুল গান্ধী, কেজরিওয়াল, অখিলেশ যাদব সহ বিরোধী ইন্ডিয়া জোটের নেতারা এক্সিট পোলের বিরোধিতা করে দাবি করলেন শেয়ার বাজারে পছন্দের ধনকুবের গোষ্ঠীদের মুনাফা করাতেই সরকারি নির্দেশে এই মিথ্যে হাইপ তোলা হয়েছে। 

৪ জুন, ২০২৪ ভোট গণনা শুরু হতেই চিচিং ফাঁক। গণনা যত এগোতে থাকল ক্রমশ স্পষ্ট হতে থাকল যে চারশো তো বহু দূর, বিজেপির পক্ষে একক ভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ২৭২ পর্যন্ত ছোঁয়া সম্ভব হবেনা। যথারীতি শেয়ার বাজারে তার প্রভাব পড়ল। সেনসেক্স প্রায় সাড়ে চার হাজার পয়েন্ট পড়ে হল ৭২,০৭৯.০৫ এবং নিফটি প্রায় দেড় হাজার পয়েন্ট পড়ে ২১,৮৮৪.৫০ অঙ্কে দিন শেষ করল। রিপোর্ট অনুসারে ইনভেস্টরদের প্রায় ৪৫ লক্ষ কোটি টাকার সম্পদ এক দিনে মুছে গেল। মার্কেট নিউজের উপর ভরসা করে ইন্ট্রাডে, অপশন ট্রেডিং করেন এমন কত লোক এক্সিট পোলের ভরসায় ট্রেডিং করে সেদিন নি:স্ব হয়ে গেলেন কে জানে। এমনকি যারা ইকুইটি ডেলিভারি করেন তাদেরও অনেকে এক্সিট পোলের ভরসায় আগের দিনের রকেট গতিতে চড়তে থাকা মার্কেটে মুনাফা করতে বেশি দামে শেয়ার কিনেছিলেন, কিন্তু পরের দিনে বাজার এক ধাক্কায় খাদে তলিয়ে যেতে আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে লস করে শেয়ার বিক্রি করেছেন। 

প্রশ্ন হল, আমজনতার এই বিপুল ক্ষতির দায়ভার কার? এর দায়ভার কি কেন্দ্র সরকার বা তাদের খুশি করতে চাওয়া চাটুকার মিডিয়া গোষ্ঠীরা নেবে? সহজ উত্তর না। শর্তাবলীতে তো লেখাই থাকে 'Investments are subject to market risk', অর্থাৎ আপনি জেনে-বুঝে ট্রেডিং করেননি কেন মশাই? কত সহজে এতবড় অর্থনৈতিক দুর্নীতি করেও এই দেশে বেঁচে যাওয়া যায় বলুন তো। 
অবশ্য এক্সিট পোল সংক্রান্ত এই মার্কেট ম্যানিপুলেশনে সবাই যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা নয়, ওসব তো মশাই আমজনতার জন্য। এই সুযোগে শেয়ার মার্কেটের হায়েনারা অর্থাৎ ব্রোকার, ম্যানিপুলেটর, দেশি বিদেশি ইন্সটিটিউশন (FII, DII) এবং সর্বোপরি বৃহৎ কর্পোরেট কোম্পানিগুলো আপনার কষ্টার্জিত অর্থ লুঠ করে এই দু-তিন দিনেই নিজেদের সম্পদ বহুগুণ বাড়িয়ে নিয়েছে।

উদাহরণ স্বরূপ, আদানি গোষ্ঠীর বিভিন্ন শেয়ার এক্সিট পোলের ভরসায় প্রায় ১৬% বেড়ে আদানি মশাইকে প্রায় ১.৪ লক্ষ কোটি মুনাফা করিয়েছে। 
৩১ মে দিন শেষে রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রির শেয়ারের দাম ছিল ২৮৬০.৮০ টাকা। এক্সিট পোল টিভিতে মোদী সরকারের বিপুল জয়ের সম্ভাবনা দেখানোর পরেই পরের ট্রেডিং সেশনই অর্থাৎ ৩ জুন শেয়ারের দাম প্রায় ২০০ টাকা বেড়ে হয়ে গেল ৩০২০.৬৫ টাকা। কারণ খুব স্পষ্ট। নিবেশকরা জানে যতদিন মোদীর রাজত্ব চলছে ততদিন আদানি, আম্বানির একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় থাকবে। অথচ ৪ জুন গণনা শুরু হতেই যখন মোদী সরকারের ফিরে আশা নিয়ে আশঙ্কা দেখা দিল সাথে সাথেই রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রির শেয়ারের দাম এক ধাক্কায় প্রায় ২২৫ টাকা পড়ে ২৭৯৪.৫৫ টাকায় পৌঁছে গেল। এক্সিট পোলের ভরসায় যেসব সাধারণ লগ্নিকারি ইন্ট্রাডে, অপশন ট্রেডিং করেছিলেন তাদের একটা বড় অংশ ডুবে গেলেন। শক্তিক্ষয় হলেও জোটসঙ্গীদের ভরসায় নরেন্দ্র মোদী তৃতীয় বার প্রধানমন্ত্রী হতে বাজারও ঘুরে দাঁড়ালো, আদানি, আম্বানির শেয়ারের দামও আবার বাড়তে থাকল। কিন্তু যেসব সাধারণ লগ্নিকারীদের পুঁজি এক্সিট পোলের ভরসায় ট্রেডিং করে ডুবে গেল সেগুলো আর ফেরত এলোনা। সেই সব টাকা শেয়ার বাজারের হাঙরের পেটে চলে গেছে। 

এরকমই আরও একটি অপেক্ষাকৃত স্বল্পচর্চিত কোম্পানি যা লগ্নিকারীদের বিপদে ফেলেছে তা হল হেরিটেজ ফুডস লিমিটেড। মূলত ডেয়ারি প্রোডাক্টস নিয়ে দক্ষিণভারতে বিশেষত অন্ধ্রপ্রদেশে কাজ করে এই কোম্পানি। মাত্র কিছুদিন আগেও এটি একটি স্মল ক্যাপ কোম্পানি ছিল যা সম্প্রতি ৫০০০ কোটির গন্ডি ছাড়িয়ে মিড ক্যাপ কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে। এই কোম্পানির ১ জানুয়ারি ২০২৪ থেকে ডেইলি চার্ট খেয়াল করলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নজরে আসবে। পয়লা জানুয়ারি কোম্পানির শেয়ারমূল্য ছিল ৩০৪.৩৫ টাকা। সেখান থেকে কোম্পানির ডেইলি চার্ট লক্ষ্য করলে দেখা যাবে সামান্য বাড়া কমার ভিতর দিয়ে স্টেডি ভাবে এগিয়ে চলেছে যাকে শেয়ার বাজারের ভাষায় বলা হয় Side wise movement। এভাবে ধীরে ধীরে বাড়তে বাড়তে ১৬ মে শেয়ার মূল্য দাঁড়ায় ৩৫৮.৬০ টাকা। ১৬ মে শেয়ারটির ট্রেডিং ভলিউম অর্থাৎ মোট শেয়ার কেনা বেচা হয় ৪.৩২ লাখ। এখান থেকে শেয়ারটি আচমকা কোন "জাদুবলে" গতি পেতে শুরু করে। ২৯ মে তে শেয়ারের দাম ৩৭১.৫৫ টাকা এবং সেদিন ৭ লাখেরও বেশি ভলিউমে ট্রেডিং হয়েছিল। এরপর যথারীতি সপ্তম দফা ভোট শেষ হল, এক্সিট পোলের রিপোর্ট এল। শেয়ারটি আচমকা রকেটের গতি পেয়ে গেল। তৃতীয় বারের এনডিএ সরকার গঠিত হল এবং তাতে গুরুত্বপূর্ণ সাহায্য করলেন তেলেগু দেশম পার্টির চন্দ্রবাবু নাইডু। একইসাথে অন্ধ্রপ্রদেশ বিধানসভায় দুরন্ত ফলাফল করে আবার মুখ্যমন্ত্রী হলেন তিনি। ফলাফল, ১০ জুন হেরিটেজ ফুডস শেয়ারের দাম আকাশ ছুঁয়ে ফেলল। ১০ জুন শেয়ারের দাম ছিল ৬৯৫.০৫ টাকা এবং ট্রেডিং ভলিউম ২০ মিলিয়ন। সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে শেয়ারের দাম আচমকা হু-হু করে বাড়ছে লোকে অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে যে দামে পাওয়া যাবে তাতেই শেয়ার কিনে ফেলে। ফলে ১০ জুন আপার সার্কিট লেগে গেল, অর্থাৎ এই শেয়ার আর কেউ কিনতেই পারছেনা কারণ কেউ বিক্রি করছেনা।

ঘটনাচক্রে, হেরিটেজ ফুডস লিমিটেডের শেয়ারের একটা বড় অংশ, ৩৫.৭১% চন্দ্রবাবু নাইডুর পরিবারের কাছেই আছে। তার পরিবারের মোট শেয়ারের পরিমাণ ৩,৩১,৩৬,০০৫ অর্থাৎ প্রায় সাড়ে তিন কোটি শেয়ার শুধু মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারের হাতেই রয়েছে। এবার একটা ছোট্ট অঙ্ক করা যাক। ২৯ মে থেকে ১০ জুন মাত্র এই কয়দিনে শেয়ারের দাম আচমকা বেড়েছে ৩২৩.৫০ টাকা। তাহলে মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারের সম্পত্তি কত বাড়ল? আজ্ঞে, বেশি না, মাত্র ১০৭১ কোটি টাকা। এমনকি চন্দ্রবাবুর ৯ বছরের নাতি দেবাংশ যার কোম্পানিতে ০.০৬% শেয়ার আছে তার সম্পদও প্রায় ১০ কোটি টাকা বেড়ে গেছে। 

কিন্তু, চন্দ্রবাবুকে বিপুল ভোটে জিতিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্যের অন্যতম মুখ বানানো আমজনতা কী পেল? আরে মশাই, তারাই তো এদের আসল শিকার। কারণ ১১ জুন থেকেই শেয়ারটিতে ধ্বস নেমেছে। ১১-১৪ মাত্র চারদিনেই শেয়ারের দাম পড়েছে ১১৭ টাকা, বর্তমান শেয়ার মূল্য ৫৭৮ টাকা। অর্থাৎ যে গতিতে উত্থান হয়েছিল সেই গতিতেই পতন হচ্ছে। গত কয়েকদিন শেয়ারটিতে লোয়ার সার্কিট লেগে আছে। অর্থাৎ, আপনি এখন চাইলেও বিক্রি করতে পারবেননা, অসহায়ের মতো শেয়ারের দামে পতন দেখতে হবে। এখন আরও কতদিন পতন হবে সেটার দিকেই তাদের তাকিয়ে বসে থাকতে হবে। মনে করুন, শেয়ারের দাম আচমকা বাড়ছে দেখে যে সাধারণ মানুষ মুনাফার লোভে ৬৫০-৭০০ এর রেঞ্জে গিয়ে কোম্পানির পাঁচশো, হাজার, দুহাজার শেয়ার কিনেছে তারা তো ডুবে গেল। এখন হয় তাদের শেয়ারের দাম আবার বাড়ার অপেক্ষা করতে হবে, অথবা লস বুক করে শেয়ার বিক্রি করতে হবে। দুটো অবস্থাতেই জনতার লোকসান আর শেয়ার বাজারের হায়েনারা আপনাকে ছিড়েখুঁড়ে খেয়ে লাভবান হবে। 
জনতা যদি সচেতন না হয় তাহলে তারা রাজনীতিবিদ, মিডিয়া বা শেয়ার বাজারের হাঙরদের হাতে খেলার পুতুল হয়েই থেকে যাবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ